শামসুল হক শারেক:
২০১৮ সালের রমজানে সর্বশেষ বউ আয়েশা বেগমকে সাথে নিয়ে মক্কা শরীফ -মদিনা শরীফ জিয়াতে গিয়েছিলাম সৌদি আরবে। এই সফরের আনন্দ উচ্ছাস আর অনুভূতি ছিল অন্যরকম। করোনাকালীন এই বন্দী সময়ে বেশ মনে পড়ছে সেই সময়ের কথা। বারবার মন চায় আল্লাহর ঘরে তাওয়াফ করতে, নবীজী সাঃ এর রওজা পাকের কাছে দাড়িয়ে সালাত সালাম পেশ করতে। কবির ভাষায় যদি বলি মন চায়-
‘গেলাফ ছু্ঁয়ে খানায়ে ক্বাবার
করব শীতল আমার আমার মন’।
সেই সময়ে তোলা লাখো আল্লাহ ভক্তদের ক্বাবা শরীফ তাওয়াফের এই ছবিটি বারবার মনে পড়ছে।
ছবি তোলা জায়েয, না জায়েয এই বিতর্কে আমি যাবনা। আমি একজন সংবাদকর্মী হিসেবে পেশাগত কারণে অনেক ছবি তুলেছি। এখনো প্রতি নিয়ত সংবাদের সাথে যুক্ত করতে হয় সংশ্লিষ্ট কোন না কোন ছবি। তবে ছবি তুলতে গিয়ে সফল হয়েছি বলতে না পারলেও বিড়ম্বনা কম হয়নি।
অনেকেই ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে সফলতা পেয়েছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফটো সাংবাদিকতা একটি আলাদা সাবজেক্ট হিসেবে স্বীকৃত। অনেকেই ছবি তুলে বিখ্যাত হয়েছেন। আবার অনেক ছবি তোলপাড় সৃষ্টি করেছে বিশ্বব্যাপী। আমার ছবি তোলার বিষয়টি কিছুটা পেশা সংশ্লিষ্ট হলেও কিছুটা শখের।
কর্মজীবনের শুরুতে একটি এনজিওতে কাজের সময় আমার এসাইনমেন্ট থাকত ছবি তোলা। সুন্দর অসুন্দর এবং যে কোন অসঙ্গতির দৃশ্য ধারণ করা থাকত এর অন্তর্ভুক্ত। তখনো কক্সবাজারে ডিজিটাল ক্যামরার ব্যবহার শুরু হয়নি। এনালগ ক্যামরায় রিল-ব্যটারী পরিবর্তন করে ছবি তুলে ল্যাবে গিয়ে ছবি করে নেয়াও ছিল অনেক ঝামেলা।
সম্ভবত ১৯৯৭ সালের দিকে একদিন টেকনাফের ঠুঁড়ায় দাড়িয়ে নাফ নদী ও মিয়ানমারের ছবি তুলছিলাম আমার ইয়াশিকা ক্যামরায়। কাকতালীয়ভাবে কয়েকজন সৌদি পর্যটক পাশাপাশি ওই জায়গা থেকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি তুলছিলেন। তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কক্সবাজারের সিও টেকনাফ থেকে কক্সবাজার ফেরার পথে আমাদেরকে একসাথে দেখে আমার পরিচিতি জানতে চান। আমার পরিচয় ও ভিজিটিং কার্ড দিলে তিনি কক্সবাজারে অফিসে সাক্ষাৎ করতে বলে চলে আসেন। পরের দিন ডিজিএফআই অফিসে গিয়ে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়েছিল।
১৯৯৭ সালেরই ঘটনা। তখন আমি দৈনিক হিমছড়ির সম্পাদক। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ কক্সবাজার সফর করেছিলেন। হাতে গুণা যে কয়জন সাংবাদিকদের এসএসএফ (ষ্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স) পাশ ইস্যু করেছিলো তার মধ্যে আমিও ছিলাম। তবে খুব কম সংখ্যক রাজনৈতিক দলের নেতা ও মিডিয়া কর্মীদের পাশ দেয়া হয়েছিল।
রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানানোর জন্য জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি (মরহুম) মোজাম্মেল হক এর সাথে আমিও ছিলাম বিমানবন্দরে। দলের কম সংখ্যক নেতাদের পাশ দেয়া নিয়ে তিনি প্রতিবাদ জানালে এসএসএফ সদস্যদের কড়াকড়ি ছিল ঘাবড়ে যাওয়ার মত। ঠিক ওই সময় রাষ্ট্রপতির বিমান ল্যান্ড করলে আমাদেরকে টার্মাকে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয়। আমরা রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানালাম একেবারে বিমানের সিঁড়িতে গিয়ে। অনভিজ্ঞতা আর ভয়ে ভয়ে সেই পুরানো ইয়াশিকা ক্যামরা ঘুরিয়ে ছবি নিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেই ছবি গুলো যথাযথ হয়নি।
আরো আগের কথা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক কর্ণফুলীতে কাজ করেছিলাম কিছুদিন। বন্যার সময় একবার কর্ণফুলীর প্রকাশক আলহাজ্ব আফসার উদ্দিন চৌধুরী কক্সবাজার আসলে আমাকে নিয়ে বন্যা পরিস্থিতি দেখার জন্য বের হন তিনি। কক্সবাজার-রামু ও চকরিয়ার বন্যা দুর্গত এলাকা ঘুরে সেই ইয়াশিকা ক্যামরায় ৩/৪টি রিল ভরে বন্যার ছবি তুলেছিলাম। মনে মনে খুশী হলাম পরের দিন আমার নামে বন্যার অনেক ছবি পত্রিকায় দেখা যাবে। কিন্তু রাতে চট্টগ্রামে একটি ল্যাবে গিয়ে রিল গুলো জমা দিলে দেখা যায় কোন রিলে কোন ছবি উঠেনি।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে কক্সবাজার সৈকতের গলফ মাঠে রেড় ক্রিসেন্টের ঘুর্ণিঝড় প্রস্তুতি সম্মেলনে এসেছিলেন একবার। মনের আনন্দে নিজের হাতে প্রধামন্ত্রীর ছবি তোলার জন্য ক্যামরা নিয়ে গিয়েছিলাম অনুষ্ঠানে। কিন্ত এর আগে জানা ছিলনা ভিভিআইপি তথা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে এসএসএফ এর অনুমতি ছাড়া ক্যামরা ব্যবহার করা যায়না। অগত্যা পথেই ক্যামরা ও হাতের ঘড়ি খুলে রেখে দিয়েছিল এসএসএফ।
২০০৫ সালের দিকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই দিনের সফরে এসেছিলেন কক্সবাজারে। এ সফরে হোটেল সীগালের সম্মেলন কক্ষে সার্ক পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন তিনি। ওখানে এসএসএফ এর পাশ থাকা সত্বেও কড়াকড়িতে ছবি তোলা যায়নি।
বিএনপি-জামায়াতের চার দলীয় জোট সরকারের মাঝামাঝি সময়ে একবার তৎকালীন থাইল্যান্ডের প্রধামন্ত্রী তাকসীন সিনাওয়াত্রার সফর ছিল কক্সবাজারে। তখনো নিরাপত্তা বাহিনীর কড়াকড়িতে ছবি তোলা হয়নি।
একইভাবে মিয়ানমারের তৎকালীন প্রধামন্ত্রী খীন নিউন্টনের সফর ছিল কক্সবাজারে। বাংলাদেশ-মিয়ানমার মৈত্রী সড়কের বাংলাদেশে ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিল রামুর বাইপাসের উত্তর প্রান্তে এবং সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার অংশের তুমব্রুতে। এসময় তৎকালীন যোগাযোগ ও সড়ক মন্ত্রী ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী সালাহ উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন। আমরা মিয়ানমারের তুমব্রুতে গিয়ে ভিত্তি স্থাপন সভায় যোগ দিয়েছিলাম এবং ছবি তুলেছিলাম।
২০১৬ সালে ভারতের শিলং ভ্রমণকালে অনেক দর্শনীয় স্থানের ছবি তুলেছিলাম। কিন্তু শিলংস্থ ভারতের পরিবেশ মন্ত্রীর বাসার সামনে ছবি তুলতে বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
একইভাবে ২০১৮ সালে কলকাতা ভ্রমণের সময় ভিক্টোরিয়া জাদুঘরে ছবি তুলতে বাধার সম্মুখীন হই। সেখানে বৃটিশদের কবল থেকে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতার দলীল এবং বৃটিশ ও মোঘল শাসনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস রয়েছে। নিষেধাজ্ঞা থাকায় ভেতরের কোন ছবি নেয়া যায়নি।
ওই সময় কলকাতার মুকুন্দপুরে ‘রবিন্দ্র ঠাগুর’ বিশেষায়িত নারায়না হেলথ হাসপাতালে ছবি উঠাতে গিয়ে প্রচন্ড বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এক প্রতিবেশীর কিডনি ট্রান্সপার বিষয়ে গিয়েছিলাম ওই হাসপাতালে।
২০১৮ সালের রমজান মাসে আমার বউ আয়েশা বেগমকে নিয়ে ওমরা পালন করতে গিয়েছিলাম সৌদি আরব। হজ্ব ওমরায় যাওয়ার সুযোগ আরো আগে হয়েছে। তবে ছিল সেবার ছিল ব্যতিক্রম। আমাদের একই সাথে না হলেও এক সপ্তাহ আগে আমার শ্বশুর আলহাজ্ব মাওলানা বদিউজ্জামান ও ওমরা করতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি ছাড়াও দেখা হয়, মামা শ্বশুর মোহাম্মদ আয়াজ ও চাচা শ্বশুর কবির আহমদ এবং হাফেজ শাব্বির আহমদসহ অনেক আত্মীয় স্বজন ও পুরানো বন্ধু বান্ধবের। এসময় মক্কা-মদিনা ও তায়েফের বিভিন্ন স্মৃতিময় স্থানসহ বায়তুল্লাহ শরীফের ছবি ধারণ করতে পেরে খুবই তৃপ্তি পেয়েছিলাম।
কিন্তু মদীনা শরীফে গিয়ে নবীজির রওজা পাকে সলাত সালাম পেশ করে ছবি তুলতে গিয়ে কেন যেন বেয়াদবি হবে মনে হয়েছিল। তাই রওজা পাকের সামনে দাড়িয়ে ক্যামরা উচিঁয়ে ছবি তুলার সাহস করতে পারিনি। দেশে এসে যে মোবাইলে মক্কা-মদীনার বহু স্মৃতিময় ছবি তুলেছিলাম সেই মোবাইলটি এক চোর মহোদয় আমার পেন্টের পকেট থেকে নিয়ে গেলে সব ছবি গুলো হারিয়ে ফেলি। হেরম শরীফে দাড়িয়ে তোলা কাবা শরিফের কয়েকটি ছবি আমার ছেলে নাঈম ও ছোট বোন নাজিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলাম।
আমার মতে বায়তুল্লাহর সেই ছবিগুলো ছিল আমার তোলা সেরা ছবি।
২০০৪ সালে একবার আমি পবিত্র ওমরা আদায় করতে সৌদি আরব যাই। আমার বন্ধু তখন জেদ্দা প্রবাসী টেকনাফের তারেক রশীদ থ্রী ম্যাগা ফিক্সেলের একটি ডিজিটাল ক্যামরা আমাকে গিফট করেছিল। ক্যামরাটি নাকি সে থাইল্যান্ড সফরের সময় শখ করে কিনেছিল। সম্ভবত কক্সবাজারের সাংবাদিকদের মাঝে এটিই ছিল প্রথম ডিজিটাল ক্যামরার ব্যবহার। পরবর্তীতে অবশ্য অনেক উন্নত ক্যমরার ব্যবহার শুরু হয়। আর এখন তো মোবাইল ক্যামরা একই সাথে টু-ইন ওয়ান।
এই ক্যামরার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ছবির কথা মনে রাখার মত। ইনকিলাব অফিসে আমার সহকর্মী জসীম উদ্দিন সাঈদ ওই ছবিগুলো ক্যামরা বন্দী করেছিল।
বতর্মান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতা থাকাকালে আব্দুর রহমান বদি (পরে এমপি) ‘র আয়োজিত উখিয়ায় আওয়ামী লীগের জনসভা মঞ্চে শেখ হাসিনা ও বদি মুখোমুখি কথা বলার সময়টি ছিল একটি দুর্লভ মুহূর্ত। সেই দুর্লভ মুহুর্তের ঐতিহাসিক ছবিটি ক্যামরা বন্দী করেছিল জসীম উদ্দিন সাঈদ। পরে ইনকিলাব অফিস থেকে ওই ছবিটি নিয়ে হাজার হাজার পোষ্টার করে ছিলেন বদি।
পর্যটন মৌসুমে একদিন এই ক্যামরা দিয়ে সৈকতে দাঁড়িয়ে আমি আর প্রথম আলোর সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানা ছবি তুলি। অফিসে গিয়ে ওর পছন্দের স্ন্যাপ গুলো তাঁকে পাঠিয়ে দিই। ওর পছন্দের একাধিক ছবি দিয়ে হয়ত সে রিপোর্ট করে।
আর আমার পছন্দের একাধিক ছবি দিয়ে আমি রিপোর্ট করি। পরের দিন দেখি একই ছবি দিয়ে ইনকিলাব ১ম পৃষ্ঠায় আর প্রথম আলো ভেতরের পৃষ্ঠায় নিউজ করে। এনিয়ে আমরা দুইজনকেই হেড অফিসে ব্যখ্যা দিতে হয়েছিল।
আমার তোলা পর পর দুইটি ছবি দৈনিক ইনকিলাবের নববর্ষের ক্যালান্ডারে স্থান পেয়েছিল। এতে খুব ভাল লেগেছিল। এর একটি আমার গ্রামের ধান ক্ষেতের দৃশ্য। অপরটি মহেশখালীর আদিনাথ ঘাটের নতুন জেটির দৃশ্য।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।